থলের বিড়াল কি বেরিয়ে গেছে

 


লোকসমাজে চলতে, সাথীর সাথে ঘুরতে-ফিরতে, হাস্যরস করতে, কুশল বিনিময়ে তেমন কোনো সমস্যা হয় না। বহু দূর এক সাথে যাওয়া যায়। মত-পথ নিয়ে উভয়ের মধ্যে যদি অন্তত ৫১ শতাংশ বিষয়ে অভিন্ন চিন্তাচেতনা থাকে। পক্ষান্তরে ৫১ শতাংশ বিষয়ে কারো সাথে যদি দ্বিমত থাকে, চিন্তাচেতনায় বৈপরীত্য স্পষ্ট হয়- সে ক্ষেত্রে তর্ক-বিতর্ক, কলহ-বিবাদ, বিচ্ছেদ হওয়া শুধু স্বাভাবিক নয় অনিবার্য। এ সত্য শুধু ব্যক্তি নয়, সমাজ এবং একইভাবে রাষ্ট্রীয় জীবনে অমোঘ সত্য। এখন যারা এ ভূখণ্ডের কর্তৃপক্ষ বলে ভাবেন, তাদের সাথে এ ভূভাগের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের চিন্তাচেতনা, ধ্যান-ধারণায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মতপার্থক্য স্পষ্ট। সে কারণে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি এই পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। অবশ্য এ নিয়ে কারো ভিন্ন মত থাকতে পারে।
এই দ্বিমত থেকে বর্তমানে যত কোলাহল। চরম শক্তিমত্তা আর অসহিষ্ণুতা দেখাচ্ছে কর্তৃপক্ষ।

এমন ভূমিকার বিপক্ষে শিশু-কিশোর যুবশক্তি মাঠে-ঘাটে, নগর-মহানগর, গ্রাম-গঞ্জে, বন্দরে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে। এ অকুতোভয় শিশু-কিশোরদের ন্যায্যতাকে সমর্থন জানিয়ে তাদের সাথে থাকছেন সময়ের কিছু বীর। আবার নেপথ্যে বসে হাতের কলম নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ন্যায়-অন্যায়ের সীমারেখা টেনে চলেছেন। সময় যাদের দেহমনে ক্লান্তি জমাট করেছে, তারাও বসে নেই। তাদের কষ্টের কথা, মনোবেদনার কথা নানা ফাঁক-ফোকর দিয়ে প্রকাশ করছে। যারা বয়সের ভারে আরো ভারাক্রান্ত বা রোগাক্রান্ত তাদের চোখ থেকে জলধারা ঝরছে অনিবার। সেটা কেবল জল নয়। এই জলের ফোঁটা যেখানে পড়ছে সেখানে প্রদাহের সৃষ্টি হচ্ছে।

নিরীহ পক্ষিকুলের শেষ আশ্রয়স্থল তার ছোট্ট নীড়। গোধূলিলগ্নে পক্ষিকুল যদি কুলায় ফিরে দেখে লতাপাতা দিয়ে গড়া তার শেষ আশ্রয়টি ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, তখন তার চেয়ে নিঃসহায় নিরাশ্রয় কে আর! সভ্যতার এ লগ্নে মনুষ্যকুলের শেষ আশ্রয়স্থলটি কোথায়। তা নিয়ে বলা-কওয়ার কিছু নেই। কেননা আজকের মানুষের বোধ-বিবেচনা হিমালয়ের চূড়ায় গিয়ে ঠেকেছে। অতএব এ নিয়ে যোগ-বিয়োগের সুযোগ কোথায়।

আসুন এখন এমন কিছু খবরাখবরের ওপর চোখ বুলাই। মনুষ্যকুলের শেষ ভরসার স্থানটির কোন হাল অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। এ ক্ষেত্রে সব বিবেচনায় নিয়ে সতর্কতা অবলম্বন করে পথ চলতে হবে, বিপদ থেকে দূরে থাকতে হবে। সময়টা আসলে ভালো না। ঘরে ঘরে বিপদ হানা দিচ্ছে। শুধু প্রার্থনা করুন কিছু একটা সুরাহার। সবার জানা যে, যত উল্লম্ফন করুক, সবার সীমাবদ্ধতা আছে। সময়ের একটা শেষ সীমা আছে। তা অতিক্রম করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এই আলাপ এখন থাক। খবরাখবর নিয়ে কথা শুরু করা যাক।

প্রথমে যে খবরটিতে চোখ রাখা যেতে পারে, সেটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে দুই মাসের বেশি সময় আগে। বলে রাখা দরকার; যে খবর এখানে উদ্ধৃত করা হচ্ছে তা নিয়ে কথা হতে পারে। এ ছাড়া কিছু পূর্বের; কিছু হালের। পাঠকসমাজ থেকে প্রশ্ন হতে পারে, এসব খবরের পরম্পরা কিভাবে বোঝা যাবে। এর যোগসূত্রটি হতে পারে কেবলই ব্যত্যয়। সব ব্যত্যয় এখানে সন্নিবেশিত হবে। যে খবরটি দিয়ে গল্পটি শুরু করা হবে, সেটি কোনো আষাঢ়ে গল্প নয়। ২৭ মে ২০২৪ তারিখে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় সংবাদটি প্রকাশিত পেয়েছে। যার শিরোনাম হচ্ছে ‘আরেক মামলায় খালাস মনির’। খবরে বলা হয়, অস্ত্র আইনে মামলার পর আট কেজি সোনা ও কোটি টাকা উদ্ধারের বিষয়টি নিয়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনে করা মামলায় খালাস পেলো মনির হোসেন ওরফে ‘গোল্ডেন’ মনির। আদালতের রায় থেকে এ তথ্য এসেছে যে, বাড্ডায় মনিরের বাসা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে র্যাবের জব্দ করা এক কোটি ৯ লাখ টাকা, আট কেজি সোনা ও বৈদেশিক মুদ্রা বৈধভাবে উপার্জনের মাধ্যমে অর্জিত। আইনত এখন আর বলার কোনো সুযোগ নেই যে, এ বিপুল অর্থ কিভাবে এলো। এ দিকে মনিরকে গ্রেফতারের পর র্যাবের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছিল, রাজধানীর গাউছিয়া মার্কেটে কাপড়ের দোকানের বিক্রয়কর্মী ছিল মনির। বিমানবন্দরকেন্দ্রিক চোরাচালানকারীদের সাথে জড়িয়ে মনির পরিচিতি পায় ‘গোল্ডেন মনির’ নামে। বিক্রয়কর্মী থেকে চোরাচালানকারীদের সাথে যোগ দেয়ার পর মনির শুরুতে কর ফাঁকি দিয়ে পোশাক, প্রসাধন, ইলেকট্রনিক পণ্য, কম্পিউটার সামগ্রীসহ বিভিন্ন মালামাল আনানেয়া করত। পরে ভূমিদস্যুতার মাধ্যমে মনির অসংখ্য প্লটের মালিক হয়। পরে র্যাবের করা অস্ত্র ও সোনা উদ্ধারের দুটি মামলার ‘তদন্ত’ করে পুলিশ। সে সুবাদে এখন সব অভিযোগ খারিজ হয়ে গেছে। গোল্ডেন মনির এখন ধোয়া তুলসী পাতা।

‘মনির কাহিনীর’ কয়েক বছর আগে ক্যাসিনো কিং এবং তার কিছু পার্শ্বচর আর পারিষদ আটক হয়েছিল। একদা এক শুভ প্রভাতে কিং অ্যান্ড অল দ্যা কিংস ম্যান বীরদর্পে খোলা হাওয়ায় বেরিয়ে আসে। প্রশ্ন, তবে কেন তারা আটক হলো এবং কিভাবে বেরিয়ে এলো। এর উত্তর কেউ পাইনি। উত্তর চাওয়ার জন্য এমন হিম্মত আর বুকের পাটা কার আছে। ৭ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে নির্বাচন নামে এক বস্তু এখানে সংঘটিত হয়েছে। সেখানে যে কত ‘সারপ্রাইজ’ ছিল তা বলে শেষ করা যাবে না। নিশ্চয় সেই সারপ্রাইজগুলো সবার মনে থাকার কথা। ভুলে যাওয়ার মতো ঘটনা তো নয়। কেননা সেসব কোনো মামুলি বিষয় ছিল না। শাসক দলের আজন্ম শত্রু আর এক দলে এক পাতি নেতার মাথায় ও ঘাড়ে অসংখ্য মামলা হামলায় ন্যুব্জ হয়েছিল। ঠিক আবারো এক শুভ সকালে সেই পাতি নেতা তার রঙ বদলালেন। মুহূর্তে তিনি শত্রু থেকে পরম মিত্র হয়ে গেলেন। সব মামলা হামলা কোথায় যে হারিয়ে গেল কেউ জানল না। এমন বহু গল্প আছে, তার কোনোটা আষাঢ়ে গল্প নয়। চেতনাহীন কেউ প্রশ্নও করতে পারেন। মামলা হলো কেন আর সেগুলো গেলইবা কোথায়? ইংরেজি ভাষায় একটি শব্দের কথা সবাই জানে ‘মিরাকেল’। মিরাকেল মিয়াতো সব কাজের কাজি। দিনকে আঁধারে ঢেকে দেয়ার মতো জাদুমন্ত্র তার জানা। তাছাড়া মন্ত্র পাঠকালে তার পেছনে যে কালো পর্দা থাকে সে পর্দার আড়ালে ছিল হামটি ডামটি অ্যান্ড অল দ্য কিংস ম্যান। তারা সেই মিরাকেলের কুশীলব। যাদের এমন অল দ্য কিংস ম্যান আছে তাদের নো চিন্তা ডু ফুর্তি।

সবাই দেখেছেন-শুনেছেন। কখনো কোনো অজোপাড়া গায়ে কিছু ব্যত্যয় হলে প্রশংসনীয় উদ্যোগ ঢাকা থেকে নেয়া হয়। তবে সমাজ সংসারের কিছু ‘একসেপশন’ সব সময় থাকে। এবারো এমন অবাক করার মতো কিছু এক্সসেপশন বহুজনকে কষ্ট বেদনা দিয়েছে। তথাপি কেউ কিন্তু মুখ ফুটে এ নিয়ে কিছু বলতে সাহসী হননি। কারণ আগেই বলা হয়েছে, বিপদ যে কার দুয়ারে কখন কড়া নাড়বে কেউ বলতে পারে না। বিপদ এলে সেই শেষ আশ্রয়টা পাবে কোথায়। কোটা বৈষম্যের প্রতিকার নিয়ে যে শিশু-কিশোর যুবারা রাজপথ প্রকম্পিত করেছে। তাদের নেতাদের নিয়ে কি হয়েছে। সেটা সবার মুখস্থ। তারা কী কোনো শেষ আশ্রয় পেয়েছেন।

ছাত্রসমাজের দাবি আদায়ের যেসব আয়োজন ক্রিয়াকর্ম। তাকে প্রায় সবাই ইতিহাস সৃষ্টিকারী অভূতপূর্ব এক আন্দোলন বলে মনে করেন। এ কথা মানতে যদি কারো দ্বিধা থাকে, তবে এ নিয়ে তর্ক জুড়ে দেয়ার কোনো দরকার নেই। সবখানে সব সময় প্রতিটি ঘটনা সংরক্ষিত হয়। মোটাদাগে তাই ইতিহাস। ইতিহাসেরও দুটি পিঠ আছে। যারা একে যৌক্তিক দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করেন সেটা ইতিবাচক। যারা সেই ঘটনাপ্রবাহ অপ্রয়োজনীয়, ক্ষতিকর হানিকর বলে সাব্যস্ত করেন তাকে নেতিবাচক বলে ধরে নেয়া হয়। এ নিয়ে বাহাসের কোনো প্রয়োজন নেই। সময়ই তার যথাযথ মূল্যায়ন করে সঠিক স্থান কার কোথায় তা নির্ণয় করে দেবে। যে কথাটি প্রকৃতপক্ষে বলার জন্য এই গৌরচন্দ্রিকা, সেটা পেশ করা যাক। ছাত্রসমাজ অব্যবহিত পূর্বে রাজপথ, জনপথ, নগর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জকে পদভারে প্রকম্পিত করেছিল। সেই কম্পন সৃষ্টিকারীদের প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ ও তার সহযোগীদের নিয়ে ভিন্ন এক ইতিহাস রচিত হয়ে গেছে। রাজপথে কম্পন সৃষ্টিকারীদের মধ্যে ভয়ভীতি সৃষ্টি করে তাদের নিবৃত্ত করা যায়নি। সে অধ্যায় আপাতত থাক।

এ দেশে একটি কথা বহুল প্রচলিত। সেটা হলো ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো’। অর্থাৎ একের স্খলন অপরের ঘাড়ে তুলে দেয়া। গত দেড় দশকে এটা এখানে অনুশীলন হয়ে আসছে। বৈষম্য দূর করা নিয়ে আন্দোলনের সময় বহু স্থানে কে বা কারা জ্বালাও পোড়াও করেছে।
বরাবরের মতো এ নিয়ে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর প্রচেষ্টা হচ্ছে। তবে সব সময় এমন কাজের সত্যটা ফাঁক-ফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসে। তেমন একটি খবর সম্প্রতি দেশের প্রধান জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। খবরটি উদ্ধৃত করে আজকের এই লেখা শেষ করতে চাই। সে খবরের শিরোনাম ‘আট যুবকের স্বীকারোক্তি, শ্রমিক লীগ নেতা গ্রেফতার।’ খবরটিতে প্রবেশ করা যাক। চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) চারটি বাসে আগুন দিতে চার লাখ টাকায় চুক্তিবদ্ধ হন এক লেগুনাচালক। ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ফুটেজ দেখে পুলিশ লেগুনাচালক সোহেল রানাকে (৩২) গ্রেফতার করেছে। গত সোমবার তার কাছে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নগরের বায়েজিদ বোস্তামীতে থাকা শ্রমিক লীগের সভাপতি দিদারুল আলমকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গত মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রামের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আওলাদ হোসেন মুহাম্মদ জুনায়েদের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন সোহেল। আদালত সূত্র জানায়, জবানবন্দীতে সোহেল বলেন, শ্রমিক লীগ নেতা দিদারুলের নির্দেশে বিআরটিসি বাসে আগুন দেন তিনি। তাকে চার লাখ টাকা দেয়ার কথা ছিল। অগ্রিম হিসাবে পান ৫০০ টাকা।

নগরের অক্সিজেন-হাটহাজারী সড়কের নতুনপাড়া এলাকায় বিআরটিসির ডিপোতে গত ২০ জুলাই রাত ১২টার দিকে চারটি বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়। খবরটিতে আরো কিছু এভিডেন্স আছে। যেহেতু এতটুকুতে থলের বিড়াল বেরিয়ে এসেছে; সে জন্য আর জায়গা খরচ করা হলো না। পাঠক যদি পুরো খবরটি পড়তে চান তবে ২৪ জুলাই দৈনিক প্রথম আলোর তৃতীয় পৃষ্ঠায় চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন। পুনশ্চ: পাতিলের ভাত যেমন সবগুলো টিপে দেখতে হয় না, তেমনি চট্টগ্রামের ঘটনা সেই ইঙ্গিত দেয়।

LihatTutupKomentar